কিতাবসূহের প্রতি ঈমান করা আকীদার উসূলসমূহের একটি অন্যতম উসূল এবং ঈমানের রুকনসমূহের একটি অন্যতম রুকন। যে সব কিতাবসমূহ আল্লাহ তার রাসূলদের ওপর নাযিল করেছেন সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা ছাড়া কারো ঈমান শুদ্ধ হবে না। আর কিতাবসূহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ মাখলুকের প্রতি দয়া করে এবং তাদের হিদায়াতের জন্য তার রাসূলদের ওপর যা নাযিল করেছেন তা, যাতে তারা তা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা লাভ করতে পারে। কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান কয়েকটি বিষয়কে অর্ন্তভুক্ত করে: 1- এ কথা বিশ্বাস ও স্বীকার করা যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার রাসূলদের ওপর তার বান্দাদের প্রতি সুস্পষ্ট সত্য ও হিদায়েতের সাথে অবতীর্ণ। এটি আল্লাহর কালাম আর কারো কথা নয়, আল্লাহ এ দ্বারা যেভাবে চেয়েছেন এবং যে পদ্ধতিতে ইচ্ছা করেছেন সেভাবে সত্যি সত্যি কথা বলেছেন। এটি হক ও সত্য। আর তাতে রয়েছে হিদায়াত ও নূর এবং যাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তাদের জন্য যথেষ্টতা। 2- কুরআনে যা রয়েছে তার প্রতি বিশ্বাস করা ও সন্তুষ্ট থাকা এবং পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ হতে অবিকৃত বিধানসমূহ, বিশ্বাসসমূহ, সংবাদসমূহ ও কাহিনীসমূহে বিশ্বাস করা। সব কিতাব তার কতক কতককে সত্যায়ন করে। আর পূর্বের কিতাব সমূহের কতক কতক দ্বারা রহিত হওয়া হক। যেমন তাওরাত কতক শরীআত রহিত করেছে। আর পূর্বের সব কিতাবকে কুরআনের রহিত করে দেওয়া হক। আর তার কতক আয়াত কতক দ্বারা রহিত হওয়া হক। 3- আল্লাহ যে সব কিতাবের নাম নিয়েছেন তার প্রতি ঈমান আনা। যেমন, ইবরাহিমের ওপর নাযিলকৃত সহীফা। মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত তাওরাত আর ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত ইন্জিল ও দাউদ আলাইহি ওয়াসাল্রামের ওপর নাযিলকৃত যাবুর এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত কুরআন। আর কুরআন হলো সবোর্ত্তম ও সর্বশেষ এবং সব কিতাব সত্যায়নকারী। সব মানুষের ওপর ফরয হলো তারই অনুসরণ করা এবং তার ফায়সালাকে মেনে নেওয়া। তার হক আদায় করা, তার প্রতি আত্মসমর্পন করা, তা থেকে প্রতি হত করা তার তিলাওয়াত করা এবং তাতে চিন্তা ফিকির করা।
তাওরাত: আসমমানি কিতাবসমূহের একটি কিতাব যেটি আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহি সালামের ওপর নাযিল করেছেন। ইয়াহুদীদের পরিভাষা ও তাদের বর্তমান বিশ্বাসে এটি হলো বিকৃত তাওরাত যাকে তারা পাঁচটি দফতর বলে বিশ্বাস করে, যা মূসা আলাইহিস সালাম নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাকে তারা বিনতাতুক করে নাম রাখে। এটি ইউনানি শব্দ যা বিনতা এর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। এটিও ইউনানী শব্দ অর্থ পাঁচ (খামছাহ) অর্থাৎ পাঁচটি দফতর। আর দফতর সমূহ হলো, তাকবীন, খুরুজ, আউয়াবীন, আদদ, তাসনীয়্যাহ। তাওরাত রহিত হয়ে গেছে। তাই সেটি অনুযায়ী আমল করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ সংবাদ দেন যে, কুরআন হলো পূর্বের সব আসমামী কিতাবসমূহের ওপর ফায়সালাকারী। অনুরূপভাবে আল্লাহ এও সংবাদ দেন যে, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা তাদের আসমানি কিতাবকে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছে এবং তারা তার ওপর মিথ্যাচার ও অপবাদ দেয়ার জন্য তাতে এমন কিছু ঢুকিয়েছে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়।
কুরআন: এটি আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত। এটি আল্লাহর কালাম, মাখলুক নয়। আর এটি ইসলামের আকীদা, ইবাদত, আহকাম ও আদাবসমূহের কিতাব। কুরআনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, সম্মান, ইয্যত, মহত্ব ইত্যাদি। আর কয়েকটি কারণে কুরআনকে সম্মানি (কারীম) হওয়ার গুণেগুণান্বিত করা হয়েছে। তার মধ্যে থেকে কয়েকটি হলো: 1- যার বাণী তার, মহত্ব, বড়ত্ব ও সম্মান। 2- তাতে রয়েছে মানুষকে সম্মান দেয়া এবং সমস্ত উম্মতের ওপর তাদের প্রাধান্য দেয়া। 3- এটি এমন একটি কিতাব যাতে অধিক কল্যাণ ও বরকত প্রদান করা হয়েছে। ফলে তার তিলাওয়াতকারীকে সাওয়াব, ইলম ও আদব প্রদান করা হয়। 4- এটি তার স্বীয় শব্দ ও অর্থে একটি পবিত্র, মহান ও সম্মানি কিতাব।
ইঞ্জিল: এটি সে কিতাব যা আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর তাওরাতের পরিপূর্ণকারী ও সমর্থনকারী হিসেবে নাযিল করেছেন। আর অধিকাংশ শরয়ী বিষয়ে এটি তার মোতাবেক ছিল। এটি সিরাতে মুস্তাকীমের দিকে নিয়ে যায়। এটি বাতিল থেকে হককে স্পষ্ট করে। এটি গায়রুল্লাহকে ত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহ্বান করে। ইঞ্জিলের নিজস্ব বিধান খুব কমই রয়েছে। এর অধিকাংশ বিধান তাওরাতের বিধানের অনুসরণ করে। ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার পরে- খৃস্টানদের ধারণা মতে, তার মৃত্যুর পরে- ইঞ্জিলে বিকৃতি ঘটে। তাতে পরিবর্তন হয়, বাড়ানো হয় ও কমানো হয়। পূর্বের কিতাবসমূহ রহিতকারী আসমানি কিতাব হলো কুরআন। খৃষ্টানদের নিকট গ্রহণযোগ্য ইঞ্জিল চারটি। আর তা হলো, ইঞ্জিলে ইউহান্না, ইঞ্জিলে মুরকুস, ইঞ্জিলে মাত্তা ও ইঞ্জিলে লুকা। এ সব ইঞ্জিলের আলোচ্য বিষয়গুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা সম্ভব। সংক্ষিপ্তাকারে তা নিম্নরূপ: 1- কাহিনীসমূহ: অধিকাংশ অধ্যায় জুড়েই রয়েছে ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাহিনী। তার জন্ম, তারপর তার দাওয়াত, তারপর তাকে শুলে চড়ানো, তার দাফন করা, কবর থেকে তাকে উঠানো, তারপর তাকে আসমানে তুলে নিয়ে যাওয়াসহ প্রভৃতি ঘটনা সম্পর্কে তাদের ধারণা মোতাবেক আলোচনা করে। 2- বিশ্বাসসমূহ: ঈসা মাসীহের ইলাহ হওয়া এবং তার আল্লাহর পুত্র হওয়া এবং বিকৃত নাসরানী দীনের মৌলিক আকিদা সাব্যস্তের ওপর গুরুত্বারোপ করে। তবে ইঞ্জিলসমূহ থেকে ইউহান্না ইঞ্জিল এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশী সাব্যস্ত করে। 3- শরীআত: ইঞ্জিলসমূহ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, এগুলো মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীআতকে স্বীকার করেছে। তবে মাসীহের পরিবর্তন সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে তা ছাড়া অথবা নির্ধারিত কিছু বিষয়ের রহিতকরণ ছাড়া। আর তা হলো, তালাক, ক্ষতের কিসাস, ব্যভিচারীকে পাথর নিক্ষেপ করা। 4- আখলাক: এ অংশে আদর্শ স্থাপনে, শীথিলতা প্রদর্শনে, ক্ষম করা ও মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বাড়াবড়ি প্রতিয়মান হয়। এটি ইঞ্জিলের কতক নসে যুদ্ধের প্রতি আহ্বান করার বিষয়টি না থাকাকে প্রমাণ করে না, তবে আদর্শ ও ক্ষমার বিষয়টি বেশী ছিল। 5- বিবাহ ও পরিবার গঠন: ইঞ্জিলগুলো বিবাহের বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে তা থেকে সাধারণত এ কথা বুঝা যায় যে, বিবাহ না করা ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় সে ব্যক্তি থেকে যে বিবাহ করে নারীদের সাথে মেলামেশা করে। খৃষ্টানদের হাতে যে ইঞ্জিল রয়েছে তা ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিপিবদ্ধ করেননি এবং তা তার ওপর ওহী আকারে নাযিল হয়নি। কিন্তু তার পরবর্তীতে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। যার ফলে তাতে বিভিন্ন বৈপরিত্ব ও মত প্রার্থক্য, রবকে অসম্পূর্ণ মনে করা, নবীগণের প্রতি খারাপ মন্তব্য করা, তাদের বিকৃতির কারণে জ্ঞান-বুদ্ধি ও নকলের পরিপন্থী বাতিল আকীদাহ পরিলক্ষিত হয়। তাদের নিকট এ সব কিতাবসমূহের ধারাবাহিক কোন সনদ নেই। তারা এসব কিতাব লিখার তারিখ সম্পর্কে অসংখ্য মতে বিভক্ত। যারা ইঞ্জিলের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বুলিস(শাউল আল-ইহুদী)। বিকৃতির পর ইঞ্জিল এমন সব বিকৃত আকীদাহ দ্বারা মিশ্রিত হয়েছে যা ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার হাওয়ারীগণ জানতো না। বরং তা তিনটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর তা হলো, তাসলিস, শুলি, কুরবানী এবং মানুষের জন্য মাসীহের মুহাসাবহ। খৃষ্টানদের নিকট এ চারটি ইঞ্জিল ঐক্যবদ্ধ ফরমান হিসেবে নির্বাচন করা সম্পন্ন হয়েছে ৩২৫ সালের নিকিয়া সম্মেলনে।